শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন
সাইফ তারিক:
ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচে তেতে উঠেছে সিরিয়াও। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সিরিয়ায় রুশ সেনাদের পাশাপাশি মার্কিন সেনারাও লড়াই করছে। তবে কার বিরুদ্ধে তারা লড়ছে সেকথা কেবল তারাই জানে। গোটা বিশ্ব জানে, ওয়ার অন টেররের নামে তারা আসলে সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধেই লড়ছে। রুশ সেনারা আসাদ সরকারের দাপ্তরিক আমন্ত্রণে সিরিয়ায় রয়েছে। কিন্তু মার্কিন সেনাদের সিরিয়ায় কেউ আমন্ত্রণ জানায়নি, বিশে^র মোড়লদারি করার জন্য তারা সেখানে হাজির হয়েছে। সিরিয়া তাদের সিরিয়া ছেড়ে যেতে বলেছে অনেকবার। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি অবৈধ। ইসলামিক স্টেট (আইএস) তথা দায়েশ জঙ্গিদের এবং আল নুসরা, ফাতাহ আল শাম অর্থাৎ আল-কায়েদার নানা উপগোষ্ঠীর জঙ্গিদের তারা মদদ জোগাচ্ছে। বাহ্যত তারা দেখাচ্ছে, তারা আইএস বা আল-কায়েদার নানা উপগোষ্ঠীকে ইসরায়েলের জায়নবাদীদের সহায়তায় নানাভাবে সহযোগিতা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধে যখন দুই দেশই (পরোক্ষভাবে) মুখোমুখি তখন সিরিয়াতেও দুই পক্ষের উত্তেজনা বাড়ছে। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র উসকানিমূলক আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেছে, দেশটিতে মোতায়েনকৃত রুশ সেনারা।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট প্রায় আট বছর আগে সিরিয়া যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে। ২০১৫ সালে সিরীয় পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসে বাশার আল আসাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভøাদিমির পুতিনের রাশিয়া। মস্কো সিরিয়ায় একটি স্থায়ী বিমান ও নৌঘাঁটি স্থাপনসহ সামরিক স্থাপনা শক্তিশালী করেছে। এখন সিরিয়াতে সেনা উপস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় অনেক বিমান হামলা চালিয়েছে। ওয়াশিংটনের দাবি, ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দমনের লক্ষ্যেই এই অভিযান। এটা ওয়ার অন টেররের নামে দায়েশ-মদদের ওপর ভাসা নীতি। দ্রুততম সময়ে হামলা চালাতে সক্ষম নৌবহর মোতায়েন রাখার মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম)। এখন ইউরোপিয়ান কমান্ডের আওতাধীন থাকা সংশ্লিষ্ট নৌবহর ও এর ৫ হাজারের বেশি সেনা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে বা ইউক্রেন উপলক্ষে আরও অনেক কিছুই ঘটে গেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ঐতিহাসিক সফরের ঘটনা ঘটে গেছে। ইউক্রেনে শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে চিনপিং-পুতিন আলোচনা হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন। জেলেনস্কির সঙ্গে গত সপ্তাহে টেলিফোনে শির কথাও হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মিটমাটের বিষয়ে চীন চুপচাপ বসে থাকবে না, এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার কথাই বলেছে।
রাশিয়ায় চীনের শান্তি আলোচনার উদ্যোগে সম্মতি দিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের পর দুই নেতার যৌথ ঘোষণায় শান্তি আলোচনা অথবা যুদ্ধবিরতি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো অঙ্গীকার ছিল না। এ সপ্তাহে রাশিয়া শান্তি আলোচনা নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে। তারা সংকট নিরসনের ‘দায়িত্বশীল সংলাপ’-এর ওপর জোর দিয়েছে। মস্কো শান্তি আলোচনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।
শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলে এসেছেন, চীন ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারে। সেটা নিলে ভালোই হবে। কেবল ইউক্রেনের জন্য নয়, গোটা ইউরোপের জন্যই তা মঙ্গল বয়ে আনবে। ম্যাক্রোঁর কথাবার্তাকে খুব বেশি আমলে নেওয়া হচ্ছে না। কারণ তার দূতিয়ালির দুমুখো ভাব। তিনি ইউরোপের স্বকীয়তার কথাও বলেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ইউরোপের দেশগুলোর জন্য কতটা সম্ভব হবে সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ফ্রান্স স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ইউরোপের সচেতন বুদ্ধিজীবী মহল তাতে সমর্থনও জোগাচ্ছে, তবে ম্যাক্রোঁর প্রস্তাব কতটুকু কার্যকর হয় তা দেখার বিষয়। আমেরিকা এত সহজে তার বিশ্ব-আধিপত্য তথা ওয়ার্ল্ড হেজিমনি ছেড়ে দিতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। যাই হোক, বিশ্ব কিন্তু এককেন্দ্রিক আধিপত্যে থাকতে নারাজ।
ক্রেমলিনে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শেষে শি-পুতিন যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, চীন ও রাশিয়া একমত হয়েছে পরমাণু যুদ্ধ কখনোই হওয়া উচিত নয়। এ ধরনের যুদ্ধে কেউ জয়ী হয় না। চিনপিং বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে চীন নিরপেক্ষ থাকবে। তিনি সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। বৈঠকের পর চিনপিং বলেছেন, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করতে চান। পুতিন বলেছেন, বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত মস্কো। চিনপিং বলেন, চীন ও রাশিয়া কৌশলগত অংশীদার এবং মহান প্রতিবেশী শক্তি। তিনি পুতিনকে চলতি বছরেই বেইজিং সফরের আমন্ত্রণ জানান। পুতিন বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধ অবসানের ভিত্তি হতে পারে চীনের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা। কিয়েভ ও পশ্চিমারা রাজি হলে সমাধান সম্ভব।
প্রসঙ্গত, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চীন এর আগেই ১২ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। চিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেন, তিনি ও চীনা প্রেসিডেন্ট একান্ত বৈঠকে বেইজিংয়ের শান্তি প্রস্তাব মনোযোগ দিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, চীনের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার বেশ কয়েকটি দফা আমরা বিশ্বাস করি। চীন ও রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে খুব কাছাকাছি।
চিনপিংয়ের মস্কো সফরের মধ্যেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনার জন্য কিয়েভে যান জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। এটাকে চীনের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছে। আগে তিনি ভারত সফর করেন। সেখান থেকে পোল্যান্ড হয়ে তিনি হঠাৎ ইউক্রেনে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম জাপানের কোনো প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ চলতে থাকা কোনো দেশ ভ্রমণ যান। জাপান ইউক্রেনের জন্য ৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি মানবিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।
ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে ১২ দফার একটি প্রস্তাব পেশ করে চীন। এ প্রস্তাবের মূল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো ও আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ইউক্রেন যুদ্ধের স্থায়ী সমাধান করা। যদিও চীনের এ শান্তি প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা নেই, রুশ বাহিনী ইউক্রেন ছেড়ে যাবে কি না। ইউক্রেন সরকার বারাবার বলছে, ‘দখলদার’ রুশ বাহিনীকে ইউক্রেন থেকে শর্তহীনভাবে বিদায় নিতে হবে। তা না হলে শান্তি প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যাবে।
কিচ্ছা কাহিনি হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আষাঢ়ে গল্পের ইউরোপীয় ভার্সন তৈরি হতে যাচ্ছে। অথচ আষাঢ় মাস দেখা যায় বঙ্গীয় অঞ্চলে, বৃহৎ বঙ্গে। আষাঢ়ে গল্পের ভালো একটা সংকলন করেছিলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন। বোধহয় পল্লীকবি অভিধার যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য! যদিও কোনো এককালে ‘পল্লীবন্ধু’ ছাড়া পল্লীকবির প্রতিভার কদর কেউ বুঝত বলে মনে হয় না। আহমদ ছফা অবশ্য পল্লীকবিকে নিয়ে ভালো কথা বলেছেন, কেবল একটি বিষয় ছাড়া। সে কথা প্রকাশ্যে বলে কবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই না। লেখক-সাংবাদিক মহলের অনেকেই তা জানেন।
মার্কিন মুল্লুক সত্যিই এক আষাঢ়ে গল্পের জন্ম দিয়েছে। কাহিনি অর্থাৎ ইঙ্গ-মার্কিন পরিভাষার সাগা। পরাধুনিক আষাঢ়ে গল্প তৈরি হচ্ছে নর্ড স্ট্রিম এবং ইউক্রেনকে ঘিরে। ইউক্রেন নাকি বোমা পেতে নর্ড স্ট্রিম উড়িয়ে দিয়েছে। জার্মানি বলছে , এটা স্রেফ গুল-বাকোয়াজি। বামন যদি কখনো চাঁদে হাত দিতে পারে তাহলে বাল্টিক সাগরের গহিনে গিয়ে ইউক্রেনের লোকেরাও নর্ড স্ট্রিমে বোমা পেতে থাকতে পারে। এত সম্ভাবনার প্যাঁচ পরিসংখ্যান শাস্ত্রেও করা সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান অনেক যদি, কিন্তু, তবে-এর সমাহার হলেও এই বিদ্যা কিছুতেই আষাঢ়ে গল্প নয়। তবে রুশরা যেমন পরিসংখ্যানশাস্ত্রে ভালো, গণিতে ভালো, আকাশচারিতায় (মহাকাশে চলন) ভালো, আষাঢ়ে গল্পের খাঁজ-ভাঁজও তাদের কিচ্ছা-কাহিনিতে আছে। যেমন ‘কুড়াল দিয়ে পোলাও রান্না’ বা ‘লেজ দিয়ে মাছ ধরা’র গল্প। সোভিয়েত রূপকথা পড়তে গিয়ে আমাদের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো এ গল্পগুলো পড়েছেন। রুশ রূপকথায় বিনোদিত হওয়ার যথেষ্ট উপাদান আছে।
মূল কথায় আসা যাক, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। বিশে^র সাধারণ নাগরিকদের মূল্যস্ফীতির চাপ এবং জ¦ালানি সংকট থেকে রেহাই দেওয়ার জন্যই শান্তি একান্ত জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক/tarik69@gmail.com